তৃতীয় লিঙ্গের একজন মোসাম্মত মীরা। শিশু বয়সে তার মধ্যে যখন মেয়েলি ভাব দেখা দেয়, তখন আশপাশের লোকজন তার পরিবারের সদস্যদের কটু কথা বলত। প্রতিবেশীদের এমন কথায় মা রাতে নীরবে কাঁদতেন। মীরার ভাষায় ‘প্রথমে বুঝতাম না। যখন কিছুটা বুঝতে শিখেছি, তখন বুঝতে বাকি ছিল না যে, মা আমার জন্যই কাঁদছেন।
স্কুলে গেলে সহপাঠীরা হাফ লেডিস বলত। বাবার সঙ্গে বাজারে গেলে সবাই তাকিয়ে থাকত, খারাপ মন্তব্য করত। ভাই-বোনদের মধ্যে কিছু হলে আমাকেই দোষারোপ করত, তারাও মনে আঘাত দিয়ে কথা বলত। এক পর্যায়ে নিজেই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি। তখন আমার বয়স মাত্র ১৩ বছর। কোথায় যাব, কি করব- কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বাবার সঙ্গে যখন হাট-বাজারে যেতাম, তখন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইতো।
বাবা তাদের ধমক দিতেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমে ভৈরব শহরে এক গুরু মা’র ডেরায় অবস্থান করি। সেখানেও শান্তি মেলেনি। এলাকার মানুষের সঙ্গে দেখা হলে বলত- কি রে, এখনও মরিস নি? ২ বছর পর ঢাকায় আরেক গুরু মা’র কাছে চলে আসি। ছোট ছিলাম বলে প্রথমে কোন কাজ দিতো না। থালা-বাসন, জামা-কাপড় ধোয়া, বাজার করা ও ঘর পরিষ্কারের কাজ করতাম। গুরু মা নাচ-গান, হাততালি, কড়া লিপস্টিক লাগানো, ঢোল বাজানো শেখাতেন। এভাবে গুরু মা’র কাছ থেকে শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে ‘হিজড়াগিরিতে’ নেমে যাই।’
যে লাঞ্ছনা-বঞ্চনা থেকে রেহাই পেতে এবং একটু সুখের আশায় মীরা নীড় ছেড়ে হিজড়াগিরি খাতায় নাম লিখেছিলেন, সেই সুখ পাখি তো দেখা দিলোই না বরং মীরার জীবনে নামে কঠিন সময়। মীরা যখন রাজপথে হেঁটে হেঁটে টাকা কালেকশন করতেন, তখন অনেকেই তাকে মারতে চাইতো, টাকা ছিনিয়ে নিতে চাইতো, খারাপ প্রস্তাব দিতো।
পানি খেতে চাইলে দোকানি গ্লাস ধরতে দিতেন না, হেলপার বাসে উঠতে দিতেন না। নতুন হওয়ায় তেমন একটা কালেকশন করতে পারতেন না। তাই দিন শেষে ডেরায় গিয়ে গুরু মা’র কটু কথা শুনতে হতো। কয়েক বছর হিজড়াগিরি করার পর এই বঞ্চনার জীবন গুটিয়ে নিতে চেয়েছিলেন মীরা। তাই মতিঝিল এলাকার ফুটপাথে দোকানও দিয়েছিলেন। সমাজ তাকে সেখানেও টিকে থাকতে দেয়নি।
ক্রেতারা পাশের হকারের কাছ থেকে পণ্য কিনতেন ঠিকই, মীরার কাছ থেকে কিনলে সব টাকাই রেখে দেবে- এই ধারণা থেকে তার কাছ থেকে কেউ পণ্য কিনতেন না। বছরখানেক এভাবে চেষ্টার পর উপায়ন্তুর না পেয়ে আবার ফিরে আসেন হিজড়াগিরি পেশায়। এরপর টাকা কালেকশন করতে গিয়ে গুলিস্তানের এক রিক্সা চালকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। নিজের কালেকশনের টাকায় তার হাত খরচও চালাতেন।
৩ বছর পর সেও মীরাকে ধোকা দিয়ে মোবাইল, টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর ৮ হাজার টাকা বেতনে গৃহকর্মী হিসেবে এক বাসায় কাজ নেয় মীরা। চারদিনের মাথায় গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী পুরো মাসের বেতন হাতে দিয়ে বললেন, কাল থেকে তোমাকে আর আসতে হবে না। আশপাশের লোকজন বিভিন্ন ধরনের কথা বলছে, অতিথিরা তোমার হাতের চা-নাস্তা খেতে চাইছেন না।
প্রতিবেদকের কাছে মীরা বলেন, ‘সেদিন চোখ মুছতে মুছতে ওই বাসা থেকে বেরিয়ে আসি। ধরেই নেই, আমার জন্য হিজড়াগিরি ছাড়া আর কোন পথ নেই। তাই বাধ্য হয়ে ফের হিজড়াগিরিতে নামি। এখন রাজধানীর একটি ডেরায় থাকি। বাড়ি ছেড়ে আসার পর প্রথম দিকে ২-১ বার মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল। এখন বয়স ২৭। বাড়ি ছাড়া এই ১২-১৩ বছরের মধ্যে পরিবারের কেউ খোঁজেনি, আমিও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি। যে ডেরায় থাকি সেটিই আমার ঘর। ডেরার গুরুই বাবা-মা।’
মীরার জীবনের পরতে পরতে কষ্টের ছাপ। পরিবার, সমাজ তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দেয়নি। আঘাত পেতে পেতে এখন কোন আঘাতই তাকে আর কষ্ট দেয় না। মীরা যখন তার জীবনে ঘটে যাওয়া বাস্তবতার গল্পগুলো বলছিলেন, তখন তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিল।
বলছিলেন, ‘এই জীবন অনেক কষ্টের। মানুষ আঘাত দিয়ে কথা বলে। একজন হিজড়ার জীবনে সেই সময়টুকুই সুন্দর, যতক্ষণ না সে বুঝতে শেখে। জ্ঞান হওয়ার পর প্রত্যেক হিজড়ার জীবনে নেমে আসে কষ্টের পাহাড়। যা বলে বুঝানোর মতো নয়। পঙ্গু হয়ে জন্মালেও আজ একটা সংসার থাকত, সন্তান থাকত। জীবনে কোন দিক দিয়েই সুখ পেলাম না।’
শুধু মীরা-ই নয়, রাজধানীর হাটে-বাজারে, পথে-ঘাটে, পার্কে, সিগন্যালে তৃতীয় লিঙ্গের যে সকল মানুষ টাকা কালেকশন করেন, তাদের প্রত্যেকের জীবনের গল্প একই। পরিবার তাদের বের করে না দিলেও সমাজের কারণে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হন তারা। পরিবারের একজন হিজড়া হয়ে জন্ম গ্রহণ করায় কিংবা মেয়েলি স্বাভাবের হওয়ায় অন্য ভাই-বোনদের বিয়ে হয় না। তার কারণে পরিবারের অন্য সদস্যরা সমাজে মুখ দেখাতে পারেন না।
পদে পদে লাঞ্ছনা, বঞ্চনার শিকার হয়ে এভাবে বের হয়ে আসছেন পরিবার থেকে, নাম লেখাচ্ছেন হিজড়াগিরিতে। তবে তাদেরও এই জীবন ভাল লাগে না। তারাও চান- মানুষের কাছে হাত না পেতে, জোরজবস্তি করে টাকা না নিয়ে সাধারণ মানুষের মতন চলাফেরা করতে। ক্ষেত্রবিশেষ গুরু মা’র টার্গেট পূরণ করতে মানুষের কাছ থেকে অধিক টাকা আদায় করতে হয়। এছাড়া আর দশজনের মতো তাদের কাছে ঘর ভাড়া দিতে চায় না। দিলেও বেশি ভাড়া নেয়া হয়। বর্তমানে বাজারদর বেশি, এসব কারণেই তাদের কোন কোন গ্রুপ মানুষকে নাজেহাল করে অধিক টাকা দিতে বাধ্য করে।
রূপান্তরিত হিজড়ার সংখ্যাই বেশি ॥ হিজড়া বলতে জন্মগতভাবে নারীও নন, পুরুষও নন- এমন মানুষকেই বুঝায়। তবে এর বাইরেও যারা লিঙ্গ পরিবর্তন করেন, তারাও হিজড়া। লিঙ্গ পরিবর্তন করে কিংবা রূপান্তরিত হয়ে যারা হিজড়া হচ্ছেন, তাদেরও যে হিজড়া সংখ্যায় ধরতে হবে- সরকারও বর্তমানে সেই ধারণায় বিশ্বাসী।
মূলত মোঘল আমলে ভারত থেকে গোলাপী নামের একজন হিজড়া বাংলাদেশে আসেন। তিনিই এলাকাভিত্তিক গুরু মা’র সিস্টেম চালু করেন। সেই রেওয়াজে বাংলাদেশে হিজড়া, হিজড়াদের ডেরা ও গুরু মা সিস্টেম চলছে। হিজড়া সংস্কৃতি বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত ও পাকিস্তানে রয়েছে। অন্যান্য দেশে পথে-ঘাটে, পার্কে, সিগন্যালে এভাবে চাঁদাবাজি করা হয় না। তারা পরিবারের সঙ্গেই থাকেন, সে দেশের সরকারও তাদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে।
এখন অনেকে লিঙ্গ পরিবর্তন করে হিজড়ায় রূপান্তরিত হচ্ছে। এক সময় প্রতিবেশী দেশে গিয়ে এই কাজটি করতে হতো। এখন বাংলাদেশেই হচ্ছে। খুলনা ও ধামরাইয়ে হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে হিজড়ায় রূপান্তরিত করা হতো। এই অপরাধে ৪-৫ বছর আগে ধামরাই রোম আমেরিকান হাসপাতালটি বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। খুলনার একটি ক্লিনিকও বন্ধ করে দেয়া হয়।
দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি রাজধানীর মালিবাগ থেকে মোহাম্মদ হাদিউজ্জামান নামে এক ভুয়া সার্জারি চিকিৎসক, তার স্ত্রী সোনিয়া আক্তার ও তাদের দুই সহযোগী নুর ইসলাম এবং জনি আহমেদকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতারকৃত হাদিউজ্জামানই এক সময় খুলনায় লিঙ্গ কর্তন করে হিজড়াতে রূপান্তরিত করত। পরে ঢাকার মগবাজারে লেজার বিউটি পার্লার খুলেছিল।
সেখানে টাকার বিনিময়ে পুরুষের লিঙ্গ কেটে তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তর করত। শরীর ফর্সা করা এবং সিলিকন ব্রেস্ট ইমপ্লান্টের কাজও করা হতো সেখানে। শতাধিক মানুষকে এভাবে তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তর করেছিল তারা। গ্রেফতারের পর এমনটিই জানিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। তবে অশিক্ষিত, অভাবী ছেলেদের পাশাপাশি যেসব ছেলের একটু মেয়েলি স্বভাব রয়েছে, তারা কেউ কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ ফাঁদে পড়ে বা প্রলুব্ধ হয়ে হিজড়ার খাতায় নাম লেখায়। হিজড়ায় রূপান্তরিত হওয়ায় অনেকের শারীরিক সমস্যাও দেখা দিয়েছে।
কয়েকজনের হিজড়া হওয়ার পেছনের গল্প ॥ জনার আগের নাম ছিল জাহাঙ্গীর। মানিকগঞ্জের একটি বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র ছিল সে। দেখতে বেশ সুন্দর। নাদুস-নুদুস চেহারা। হঠাৎ করে একদিন নিখোঁজ। তার বাবা-মা দিশেহারা হয়ে পড়লেন ছেলে কোথায় গেল। সন্ধান না পেয়ে থানায় দায়ের করা হলো সাধারণ ডায়েরি। পুলিশও তার কোন হদিস পায়নি।
এক রাতে জাহাঙ্গীর বাড়ি এসে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। তিনি জানান, হিজড়াদের একটি চক্র তাকে স্কুলের সামনে থেকে ফুসলিয়ে খুলনা ফুলতলা নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে তাকে একটি ক্লিনিকে ঢোকানো হয়। চিকিৎসকের হাতে অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি। আঁতকে উঠে সে। তাকে উলঙ্গ করে অস্ত্রোপচার বেডে চিৎ করে শোয়ানো হয়। জাহাঙ্গীর বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ডাক্তারের হাতে-পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে। হিজড়া বাহিনী পিছু ছাড়েনি। পরে লিঙ্গ কেটে হিজড়া হওয়ার পর তার নামকরণ করা হলো ‘জনা’।
বর্তমানে রাজধানীর একটি ডেরায় থেকে হিজড়াগিরি করছে জনা। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সে নিজের ছবি পত্রিকায় না দেয়ার শর্তে বলে, এটা আমার ভাগ্যে ছিল। পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার কারণে আমার এই জীবনের আর কোন মূল্য নেই। জনা ছাড়াও আপন, রহিমা ও নাছিমার হিজড়া হওয়ার গল্প প্রায়ই একই। কেউ স্বেচ্ছায়, আর কেউ দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে হিজড়ায় রূপান্তরিত হয়েছেন। তারা পাল্টে ফেলেছেন বাবা-মায়ের দেয়া নাম। হিজড়ায় রূপান্তরিত হয়ে তাদের অনেকেই এখন অনুতপ্ত। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চাইলেও আর সম্ভব নয়।
যেসব শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় ॥ কেউ পুরুষ থেকে আবার কেউ নারী থেকে লিঙ্গ পরিবর্তন করে হিজড়ায় রূপান্তরিত হচ্ছে। তারা বলছেন, এতে শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। কেউ কেউ মৃত্যু ঝুঁকিতেও থাকে। লিঙ্গ কর্তন কিংবা অপারেশনের ফলে সেই স্থানে ক্ষত হয়ে যায়, পঁচে যায়। হরমোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া হলে তাদের জীবনে ভয়াবহ ঝুঁঁকি থাকে।
দেহের হাড় ক্ষয় হয়, শারীরিক শক্তি কমে যায়। এছাড়া নানা রোগের সৃষ্টি হয়। তাদের মতে, সমাজে হিজড়া বলতে তাদের বোঝায় যারা শারীরিকভাবে পুরুষ কিন্তু মানসিকভাবে নিজেদের মেয়ে ভাবে, মেয়েদের পোশাক পরতে ও মেয়েদের মতো ব্যবহার করতে পছন্দ করে। এটা হরমোনজনিত বিষয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৩ মাস আগে ‘সেক্স ডিজ-অর্ডার চিল্ড্রেন সার্জারি বিভাগ’ নামে নতুন একটি বিভাগ চালু হয়েছে। যে সকল শিশুর লিঙ্গ দেখে নারী না পুরুষ শনাক্তকরণ সম্ভব হয় না, অভিভাবক ওই সকল শিশুদের ওই বিভাগে নিয়ে যান। সেখানকার চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটি লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণ করে দেন।
প্রাপ্ত বয়স্ক অনেকেই লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য আসছে বলে জানিয়েছেন বিএসএমএমইউর হরমোন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ শাহজাদা সেলিম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তিন শিক্ষার্থী খুব পীড়া দিচ্ছে লিঙ্গ পরিবর্তন করতে। কেননা, তারা ছেলে হয়ে জন্মালেও তাদের মধ্যে মেয়েলি স্বভাব। আমাদের দেশে এ রকম কোন আইন বা নিয়ম নেই বলে বিষয়টি সম্ভব হয়নি।
আইন হলে একটি প্রকল্পের অধীনে লিঙ্গ পরিবর্তনের কাজটি বৈধভাবেই করা হবে। তখন প্রাপ্ত বয়স্ক কেউ তার অভিভাবক নিয়ে আসলে এবং ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বৈধ কাগজ বা অনুমতিপত্র দেখাতে পারলে তার লিঙ্গ পরিবর্তন করা হবে। সেই লক্ষ্যে কাজ চলছে।
সমস্যা তাদের চারদিকে ॥ হিজড়া হওয়ার কারণে তৃতীয় লিঙ্গের একজন মানুষকে ঘরে-বাইরে নানা সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। তাদের ভাষায়, ‘একজন মানুষ জন্মগতভাবে হিজড়া হওয়ায় কিংবা পুরুষ হয়েও মেয়েলি স্বাভাবের হওয়ায় পরিবার থেকে তাকে নিগ্রহের শিকার হতে হয়। পরিবারে গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। ভাই-বোনের বিয়ের প্রস্তাব আসলে প্রতিবেশীরা বলে, ওই ঘরে হিজড়া আছে। তাই বিয়ে হয় না।
পরিবারের কেউ রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে বলে, হিজড়ার বাবা আসছে। স্কুলে গেলে ইভটিজিংয়ের শিকার হতে হয়। পেছনের বেঞ্চে বসতে হয়। রাস্তায় দেখলে বলে, ছাইয়া আসতাছে, ওই যে আসতাছে...। হিজড়াগিরিতে আসার পর বৈষম্য আরও বেড়ে যায়। কোন বাড়িওয়ালাই হিজড়াদের কাছে ঘর ভাড়া দিতে চান না। দিলেও ভাড়া বেশি নেন। চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায় না। নারী না পুরুষ, এমন দ্বন্দ্বে চিকিৎসক ভুল চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। আইনী সহায়তা পান না হিজড়ারা।
পাবলিক বাসে চড়তে দিতে চায় না। গাড়ি ভাড়া বেশি নেয়া হয়। অনেক জায়গায় নারী-পুরুষের লাইন থাকলেও হিজড়াদের জন্য আলাদা লাইন থাকে না। ফলে লাইনে দাঁড়াতে গেলেও দাঁড়াতে দিতে চায় না। দোকানে কোন পণ্য কিনতে গেলেও দোকানি ধরতেই দেয় না। এভাবে পদে পদে বঞ্চনা আর বৈষম্যের শিকার হতে হয়। নেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই হিজড়াগিরিতে নামেন এবং অনেকটা জোর-জবরদস্তি করে টাকা আদায় করেন।
শত বাধা-বিপত্তিও দমাতে পারেনি যাদের ॥ জন্মগতভাবে হিজড়া হয়ে কিংবা হিজড়ায় রূপান্তরিত হয়েও অনেকে এই ‘হিজড়া কালচারের’ মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে নিজেকে আলোকিত করেছেন, স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তাদেরই একজন হলেন-সঞ্জীবনী। তিনি বর্তমানে ব্র্যাক ব্যাংকের কমিউনিকেশন অফিসার।
সঞ্জীবনীর মধ্যে যখন মেয়েলি ভাব দেখা দেয়, তখন তিনি ট্রান্সউইমেন হন। তার পরিবার তাকে বাসা থেকে বের করে দেয়নি। তিনিও পরিবারের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলেন এবং তা-ই হয়েছে। এর মধ্যেও অন্য হিজড়াদের মতো তার জীবনেও দুর্বিসহ পরিস্থিতি এসেছিল। যে বয়সে একজন হিজড়া কমিউনিটির কাছে চলে যায়, সে বয়সে সঞ্জীবনীও অজ¯্র্রবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন, ভিক্ষা পর্যন্ত করেছেন। তিনি হাল ছাড়েননি।
এক পর্যায়ে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক, স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি নেন ব্র্যাক ব্যাংকে। বর্তমানে হিজড়াদের শিক্ষা, তারা যেন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে না পারে এবং সমান সুযোগ-সুবিধা পায়- চাকরির পাশাপাশি এই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
জানতে চাইলে সঞ্জীবনী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমি হিজড়া সম্প্রদায়কে অবজ্ঞা করিনি, করবও না। চাইলে তারাও নিজেকে আলোকিত করতে পারেন, পরিবর্তন আনতে পারেন। শুধু সদিচ্ছা আর টার্গেট থাকতে হবে।’
শুধু সঞ্জীবনী নন, তার মতো কিশোর বয়সে শত বাধা এসেছিল হো চি মিন ইসলামের জীবনে। তিনিও থেমে থাকেননি। নার্সিং শেষে চাকরি করছেন রাজধানীর একটি হাসপাতালে। সঞ্জীবনীর মতো তারও ইচ্ছে আছে পিএইচডি করার। ব্র্যাক ব্যাংকের এইচআর বিভাগে চাকরি করেন অংকিতা। তিনিও তৃতীয় লিঙ্গের একজন মানুষ।
এনজিও সংস্থা ব্লাস্টের হিজড়া শাখায় চাকরি করেন শোভা সরকার। সংবাদ উপস্থাপিকা হয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের তাসনুভা। ‘সম্পর্কের নয় সেতু’ নামের একটি সংগঠনের সভাপতি জয়া শিকদার। তিনিও এক সময় হিজড়াগিরি করতেন। অন্যের মতো টাকা কালেকশনসহ অনেক কিছুই করতে হতো তাকে। পরে হিজড়াদের কল্যাণে সংগঠন খোলেন জয়া শিকদার।
বর্তমানে হিজড়াদের কর্মসংস্থান, চিকিৎসা, সুযোগ-সুবিধা প্রদান ও পুনর্বাসনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তারা বলছেন, শুধু দেহ দিয়ে পরিপূর্ণ মানুষ হয় না। তাদের শরীরটা ছিল ছেলের, তবে মন-মগজ বলত তারা নারী। সমাজে ছেলে বা মেয়ে নয়, এমন একটি শিশুর প্রতি যে অত্যাচার তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছেন শৈশবেই।
স্কুলের কেউ মানুষ মনে করত না। বয়ঃসন্ধির সময় শারীরিক পরিবর্তন দেখে ভয় পেতেন তারা। আয়নায় নিজেকে দেখে কান্নাকাটি করতেন। দাড়ি বা পুরুষালি শরীর কোনভাবেই মেনে নিতে পারতেন না। এসব অতিক্রম করে এই পর্যায়ে আসার কষ্টটা ছিল পাহাড়সম। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে একজন মানুষ হিসেবেই দেখুক, এটাই তাদের চাওয়া।
https://www.dailyjanakantha.com/national/news/666538?fbclid=IwAR39WOABVpZgK_MOaTBf5xnWHPumaYoHDwNhkpyFlzsO1BVj7qjbnkJST7s============================================================ Advocate Shahanur Islam | An Young, Ascendant, Dedicated Human Rights Defender, Lawyer and Blogger from Bangladesh, Fighting for Ensuring Human Rights, Rule of Law, Good Governance, Peace and Social Justice For the Victim of Torture, Extra Judicial Killing, Force Disappearance, Trafficking in Persons including Ethnic, Religious, Sexual and Social Minority People.
No comments:
Post a Comment